প্রাচীন যুগ ও মৌর্য রাজবংশ
|
||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||
» খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০ সালে ভারতবর্ষ ১৬ টি মহাজনপদে বিভক্ত ছিলো। » খ্রিষ্টপূর্ব ৩৬৪ অব্দের দিকে তার একটি মহাজনপদ মগধ নন্দ বংশের দখলে চলে যায়। » নন্দ বংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মহাপদ্ম নন্দ। » পুরাণ অনুযায়ী এই মহাপদ্ম নন্দই বিভিন্ন জায়গায় ক্ষত্রিয়দের পরাজিত করে গড়ে তুলেন এক বিশাল সাম্রাজ্য। » যার ছিল ২,০০,০০০ পদাতিক, ৮০,০০০ অশ্বারোহী, ৮,০০০ রথারোহী, ৬,০০০ যুদ্ধহস্তী নিয়ে বিশাল সামরিক বাহিনী। » সামরিক ক্ষেত্রে সেই সময় ভারতবর্ষ ছিলো পুরো বিশ্বে অদ্বিতীয়। » লোহা উৎপাদনে সেই সময় মগধের ধারে কাছেও কেউ ছিলো না।
» নন্দ রাজা ধননন্দের সৎ ভাই ছিলেন চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য। » চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের মা ‘মুরা’ ছিলেন নন্দ রাজার দাসী। » এই দাসীর গর্ভে মগধ সম্রাট মহাপদ্ম নন্দের ঔরষে চন্দ্রগুপ্তের জন্ম হয়। » ধননন্দ এক পর্যায়ে জোর পূর্বক তার দাসী মাতা মুরা এবং সৎ ভাই চন্দ্রগুপ্তকে রাজ্য থেকে বিতাড়িত করেন। » ধননন্দ যখন বুঝতে পারলেন চন্দ্রগুপ্ত যেকোনো সময় বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে, তখন সে চন্দ্রগুপ্তকে একেবারে শেষ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। » চন্দ্রগুপ্ত বিষয়টা বুঝতে পেরে ধননন্দের হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে গা ঢাকা দেন গভীর অরণ্যে।
» চাণক্য (৩৭০- ২৮৩ খ্রিষ্টপূর্ব) ছোট বেলা থেকেই খুব মেধাবী ছিলেন। » তিনি তক্ষশীলায় (রাওয়ালপিন্ডির কিছু উত্তর পশ্চিমে) পড়াশুনা করেছেন। » অধ্যাপনা করেছেন এই তক্ষশীলায়ই অর্থনীতি ও রাষ্ট্রনীতি নিয়ে। » তিনিই হলেন ভারতের সর্ব প্রথম অর্থনীতিবিদ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী। » চাণক্যের সবচেয়ে বড় অবদান হলো ১৫ পর্বের গ্রন্থ “অর্থশাস্ত্র”। » যেহেতু অর্থনীতি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান নিয়ে তার এতদিন যাবৎ প্রচুর পড়াশুনা সেহেতু রাষ্ট্র পরিচালনা ও রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক কাঠামো সংক্রান্ত তার কিছু মৌলিক চিন্তা ছিলো। » চাণক্য তার এই চিন্তাগুলো মগধ সম্রাট ধননন্দের সাথে শেয়ার করতেই ধননন্দের সাথে তার তীব্র মত বিরোধের সৃষ্টি হয়। » এই বিরোধের পরপরই চানক্য সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন- নন্দ রাজার অধীনে আর নয়! » তাকে হটাতে পারলেই তবে এ রাজ্যে ফিরবেন চাণক্য। » এই সিদ্ধান্ত নিয়ে চাণক্য পালিয়ে গেলেন গভীর অরণ্যে। » এই অরণ্যেই চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের সাক্ষাত পান চাণক্যের। » ধননন্দ এমনিতেই খুব অত্যাচারী রাজা ছিলেন। » প্রজাদের উপর কারণে অকারণে অবর্ণনীয় নির্যাতন চালাতেন ধননন্দ। » এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে চাণক্যের সহযোগিতায় চন্দ্রগুপ্ত অতি দ্রুত একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনী গড়ে তোলেন। » এই সেনাবাহিনী আর তার সাথে চাণক্যের কৌশল নিয়ে চন্দ্রগুপ্ত মগধ রাজ্য আক্রমণ করে ধননন্দের সুবিশাল বাহিনীকে পরাস্ত করে মগধ দখল করে নিতে সক্ষম হন।
» চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য রাজা হলেও রাজ্য পরিচালনা ও অর্থনীতি সংক্রান্ত সকল সিদ্ধান্ত আসতে চাণক্যের মাথা থেকে। » প্রথমে পুরো সাম্রাজ্যকে কয়েকটি প্রদেশে ভাগ করেন। » প্রদেশগুলোকে আবার অহর ও বিষয়ে (জেলা) ভাগ করেন। » বিষয়গুলো আবার কিছু গ্রামে বিভক্ত ছিলো। » ৪-৫টি গ্রামের দায়িত্বে থাকতেন একজন করে গোপ। » এভাবে পুরো সাম্রাজ্যকে একটি পূর্ণাঙ্গ প্রশাসনিক কাঠামোয় নিয়ে আসেন চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য, যা এর আগে আর কেউ পারেনি। » চাণক্যের মধ্যে যে গুণটা সবচেয়ে বেশি লক্ষণীয় তা হলো, তিনি অনেক দূর পর্যন্ত চিন্তা করতে পারতেন। » তারই প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই চন্দ্রগুপ্তের পুরো শাসনকাল জুড়ে। » চাণক্য বুঝতে পেরেছিলেন ভারতবর্ষে গ্রীকদের অবস্থান খুব একটা সুবিধের নয়। » তিনি উত্তর-পশ্চিম ভারত থেকে গ্রিকদের বিতারনে চন্দ্রগুপ্তকে উপদেশ দেন। » চন্দ্রগুপ্তও তা পালন করেন অক্ষরে অক্ষরে।
» খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৩ সালে আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর তার সেনাপতি সেলুকাস মগধ রাজ্য আক্রমণ করেন। » কিন্তু চন্দ্রগুপ্তের বিশাল সৈন্যবাহিনী এবং চাণক্যের কৌশলের নিকট সেলুকাসকে পরাজয় বরণ করতে হয়। » এই যুদ্ধের পর চাণক্য ও সেলুকাসের মধ্যে একটি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। » এই চুক্তি মোতাবেক কাবুল, কান্দাহার, হিরাট ও বেলুচিস্তান এই জায়গাগুলো দখল করে নেন চন্দ্রগুপ্ত এবং সেই সাথে সেলুকাস তার কন্যা হেলেনকে চন্দ্রগুপ্তের সাথে বিবাহ দিতেও বাধ্য হন। » এই চুক্তির পর সেলুকাস যখন এন্টিগোনাসের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হন তখন সেলুকাস চন্দ্রগুপ্তের কাছে সহায়তা চান এবং চন্দ্রগুপ্ত সেলুকাসকে ৫০০ যুদ্ধ হস্তি দিয়ে সহায়তা করেন। » এই হাতিগুলোই মূলত ঐ সময় সেলুকাসকে এন্টিগোনাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয় লাভ করতে সহায়তা করে।
» চন্দ্রগুপ্ত মারা যান খ্রিষ্টপূর্ব ২৯৮ সালে। » চন্দ্রগুপ্তের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র বিন্দুসার মগধের সিংহাসনে আরোহণ করেন। » তখন বিন্দুসারের বয়স ছিলো মাত্র ২২ বছর। » কিন্তু চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের মতো বিন্দুসার কোনো কারিশমা দেখাতে পারেননি। » চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য তার জীবনের শেষ পর্যায়ে জৈন ধর্মে দীক্ষিত হন। » চন্দ্রগুপ্তের ছেলে বিন্দুসার বেশ সচেতনভাবে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্ম দুটিকেই এড়িয়ে গেছেন। » অশোক হলেন বিন্দুসারের ১০০ পুত্রের মধ্যে একজন। » তার কারণ চাণক্যের প্রতি অবহেলা। » চাণক্য বিন্দুসারের সময়েও উপদেষ্টা ছিলেন। » বিন্দুসার উনার পিতার মতো চাণক্যের প্রতি আস্থা রাখতে পারছিলেন না। » তাছাড়া বিন্দুসারের আরেক উপদেষ্টা সুবন্ধুর সঙ্গে বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় বিষয় নিয়ে চাণক্যের বিরোধ বাঁধে। » যতটুকু জানা যায় বিন্দুসার ক্ষমতায় আরোহণের ১৫ বছর পর চাণক্য মারা যান। » বিন্দুসার মারা যান খ্রিষ্ট পূর্ব ২৭২ সালে। » অশোক এই মুহুর্তে হয়ে ওঠেন একজন কারিশমেটিক নেতৃত্ব।
» বিন্দুসারের ১৬ জন স্ত্রী ছিলো, এই ১৬ জন স্ত্রীর ছিলো সর্বমোট ১০০টি পুত্র। » অশোক ছিলেন এই একশো জনের মধ্যে একজন। » অশোক বিন্দুসারের জীবিত অবস্থায়ই তক্ষশীলার বিদ্রোহ দমাতে সক্ষম হন। » তাছাড়া বিন্দুসারের সেনাবাহিনীতে অশোকের ভালোই জনপ্রিয়তা ছিলো। » তক্ষশীলার বিদ্রোহ দমানোর পর অশোক তক্ষশীলার দায়িত্বেই থেকে যান। » কিন্তু বিন্দুসারের মৃত্যুর পর অশোকের মধ্যেও পুরো মগধের সম্রাট হওয়ার এক তীব্র লালসা জন্মাতে শুরু করে। » হত্যা করতে লাগলেন একের পর এক ভাইকে। » তখন অশোকের বয়স মাত্র ১৮। » এই ১৮ বছরের ছেলে বীতাশোক নামক এক ভাইকে বাদ দিয়ে নির্দয়, নিষ্ঠুরের মতো বাকি সব কয়টা ভাইকে হত্যা করেন। » মৌর্য সাম্রাজ্যের সিংহাসনে আরোহণ করেন সম্রাট অশোক। » যার সিংহাসনে আরোহণের পেছনে রয়েছে নিজের ৯৮ জন ভাইয়ের লাশ। » সিংহাসনে আরোহণের মাত্র কয়েক বছরের মাথায় (খ্রিষ্টপূর্ব ২৬০/২৬১ সালে) অশোক কলিঙ্গ আক্রমণ করেন। » মানব সভ্যতার ইতিহাসের অন্যতম একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয় কলিঙ্গে। » যুদ্ধটি হয় মূলত দয়া নদীর তীরে। » সেই সময় অশোকের সেনাবাহিনীতে ৪ লক্ষের বেশি সৈন্য ছিলো। » যুদ্ধে এই চার লক্ষের মধ্যে এক লক্ষই মারা যায়। » অন্য দিকে ঠিক প্রায় একই পরিমান কলিঙ্গ যোদ্ধাও মারা যায়। » প্লিনির বিবরণ অনুযায়ী, এ সময়ের কলিঙ্গে ৬০,০০০ পদাতিক, ১,০০০ রথারোহী ও ৭০০ রণহস্তী বিশিষ্ট এক শক্তিশালী সামরিক বাহিনী ছিলো।
» সম্রাট অশোক কলিঙ্গ যুদ্ধের ভয়াবহতা দেখে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেন। » গৌতম বুদ্ধের বাণী এ সময় অশোককে প্রবলভাবে আকৃষ্ট করে। » অশোক কলিঙ্গ জয়ের পর যখন অনুতপ্ত হলেন তখন কিন্তু তিনি কলিঙ্গবাসীকে তাদের রাজ্য ফিরিয়ে দেননি। » চাণক্যের অর্থনৈতিক ফর্মুলাগুলো অশোক বেশ সুচারোভাবে প্রয়োগ করে গেছেন বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করার পরেও সম্রাট অশোকের নির্দেশ অনুযায়ীই পুন্ড্রবর্ধন অঞ্চলে বসবাসকারী ১৮,০০০ আজীবীক সম্প্রদায়ের মানুষকে হত্যা করেন। » তখন সম্রাট অশোক বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত এক খাঁটি পুরুষ। » তৎকালীন প্রায় ৬০ হাজার বৌদ্ধ ভিক্ষুকে অশোক নিয়মিত খাবার সরবরাহ করতেন। » সম্রাট অশোকের পুত্র মহেন্দ্র ও কন্যা সংঘমিত্রা সম্রাট অশোকের আদেশ পেয়ে শ্রীলংকায় বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার করেন। » এছাড়া চীন, কাশ্মীর, গান্ধার, মহারাষ্ট্র, আফগানিস্তান, নেপাল, থাইল্যান্ড, জাপান, প্রভৃতি দেশে এখনো আমরা যে সকল বৌদ্ধ ধর্মালম্বী দেখতে পাই এটা মূলত সম্রাট অশোকেরই অবদান ছিলো। » অশোক মারা যান খ্রিষ্ট পূর্ব ২৩২ সালে। » ব্রাক্ষণদের সহায়তায় মৌর্য সাম্রাজ্যের আনুষ্ঠানিক পতন ঘটে এবং শুঙ্গ রাজবংশের উত্থান ঘটে।
» ৩২১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মৌর্য শাসন শুরু হয়। » এই মৌর্যদের সময়েই আর্যরা সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় বাংলায় প্রবেশ করেছিল। » মৌর্য সম্রাটদের তাঁর রাজত্বকালে (২৬৯-২৩২খ্রি.পূ.) উত্তর বাংলার অনেকটা অংশ মৌর্যরা দখল করে নেয়। » তাদের দখল করা অংশ মৌর্য সাম্রাজ্যের একটি প্রদেশে পরিণত হয়। » প্রদেশকে তখন বলা হতো, 'ভুক্তি'। » বাংলা অঞ্চলের এই ভুক্তিটির নাম হয় 'পুণ্ড্রবর্ধন ভুক্তি'। » এই ভুক্তিটির রাজধানী করা হয় আজকের বগুড়া জেলার মহাস্থানগড়। » সে যুগে এর নাম ছিল 'পুণ্ড্রনগর'। » ভারতে মৌর্য বংশের পতন হলে গুপ্ত উপাধি নেয়া আরেকটি রাজবংশের রাজা ক্ষমতা দখল করে। » গুপ্ত বংশের সম্রাটরা ৩০০ খ্রিস্টাব্দের শেষ দিক থেকে সাম্রাজ্য শাসন শুরু করেন। » মৌর্য সম্রাটদের অধিকার করা বাংলা গুপ্তদের অধিকারে চলে আসে।
|
||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||
| ||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||
Copyright © Sabyasachi Bairagi
|